তোমরা নিশ্চয়ই দেখে থাকবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষক মাঠের কাজ করে ফসল ফলান। মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ করে বাড়ি আনেন। কৃষাণি বাড়িতে আনা ফসল যত্ন করে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের মহিলারা বাড়ি বাড়ি হাঁস-মুরগি পালন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষেরা গবাদিপশুর খামার, হাঁস-মুরগির খামার করে কৃষি উৎপাদন করে থাকেন। মাটির জিনিসপত্র তৈরি করেন কুমার। লোহার জিনিসপত্র যেমন- দা, কাঁচি, কুড়াল ইত্যাদি তৈরি করেন কামার।
আদিযুগে পরিবারের সদস্যরা সক্ষমতা ও সুবিধা অনুযায়ী পরিবারের কাজগুলো করতেন। এভাবেই মানুষের মাঝে শ্রম বিভাজনের সুবিধা তৈরি হয়েছিল। সমাজ গঠনে এই শ্রম বিভাজন ভূমিকা রেখেছিল। দিনে দিনে পরিবারের আকার ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। মানুষ ফসলের পরিচর্যা করে ফলন বৃদ্ধি করতে শিখল। ফসল বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করল। ফলে কৃষির পরিধি ও পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকল। কৃষি বিষয়ক এসব পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ তাদের বসবাসসহ বিভিন্ন অভ্যাসের পরিবর্তন করেছিল।
মানুষ আর গুহায় না থেকে পরিবেশ থেকে মাটি, বাঁশ, কাঠ, পাতা ব্যবহার করে ঘর-বাড়ি তৈরি করতে শুরু করল। এভাবে বেশকিছু পরিবারের বসতবাড়ি মিলে গ্রামের পত্তন হয়। কৃষির কারণেই মানুষ বেশি বেশি পরিবেশ সচেতন হতে থাকল। ঋতুচক্রের উপর ফসল উৎপাদন যে নির্ভরশীল এটা শিখল। কোন ঋতুতে কোন ফসল উৎপাদন করা যায় তা বুঝল। ফলে উৎপাদন দ্রুতই বাড়তে লাগল। কৃষিকাজ এবং পরিবারের নানা আনুষঙ্গিক জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে তা উৎপাদনে কিছু লোক অন্যদের চাইতে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ায় শ্রম বিভাজন হলো। কুমার মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কামার ধাতবযন্ত্র তৈরি করতে লাগল। এভাবেই সবাইকে নিয়ে সমাজ গঠিত হলো। এই ধরনের সমাজকেই নৃবিজ্ঞানীগণ আদি কৃষি সমাজ বলেছেন। সমাজের সবাই যার যার সাধ্যমতো উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতেন এবং চাহিদামতো ভোগ করতেন। উৎপাদন ক্ষেত্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সবার সমান অধিকার ছিল। সবাই মিলে গ্রামগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতেন। গ্রামীণ এই আদি সমাজে সমস্যাও ছিল প্রচুর। এ সমাজের মানুষেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে ফসল বিনষ্ট হওয়া এমন নানা সমস্যা সবাই মিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধান করতেন। এমনকি গুরুতর পারিবারিক সমস্যাগুলোও সামাজিকভাবে সমাধান করতেন। জীবনকে ক্রমাগত সহজ ও সুন্দর করাই ছিল সবার সমবেত আকাঙ্ক্ষা। আদি সমাজে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাজপ্রধান নির্বাচিত হতেন। তিনি ঐতিহ্য ও প্রথা অনুযায়ী সমাজের কাজের সমন্বয় সাধন করতেন।
আমরা দেখেছি মানুষ তার বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে কৃষিকে একটি প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলেছে। কৃষিকে উন্নত থেকে উন্নততর করছে। কৃষির পরিধি ও পরিসর ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে। তাই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে নানা মানবিক ও সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে চাহিদা তৈরি করে চলেছে। এ কারণে বলা যায় যে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতেও কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমার চেয়ে আমার পরিবার বড়, পরিবারের চেয়ে সমাজ বড় এ মূল্যবোধও আদি সমাজের নিকট থেকে এসেছে। এ মূল্যবোধ না থাকলে কৃষি সমাজ অগ্রসর হতে পারত না।
মানব সমাজ বিবর্তনে শুভ চিন্তার পাশাপাশি অশুভ চিন্তা বা অশুভ শক্তিও ভূমিকা রেখেছে। লোভ ও ব্যক্তিস্বার্থ এদের মধ্যে প্রধান। কৃষির অগ্রগতির ফলে উৎপাদন যখন সামাজিক চাহিদা ছাড়িয়ে গেল তখন এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন কেউ কেউ নিজ দখলে নেওয়ার প্রবণতা দেখাতে লাগলেন। নানা যুক্তিতে মালিকানা দাবি করলেন। সহজেই বোঝা যায় অধিকতর চতুর ও শক্তিমান ব্যক্তিই এরকম করতে পারতেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সমাজপ্রধানদের কেউ কেউ এ পথে পা বাড়ালেন। অধিক চতুর এই ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা শুধু সামাজিক সম্পদই কুক্ষিগত করলেন না, সম্পদ ও শক্তির জোরে এক সময় ঘোষণা করলেন যে এরপর থেকে আর সমাজপ্রধান নির্বাচিত করার প্রয়োজন নেই, বংশানুক্রমে সমাজপ্রধান হবেন। এর ফলে দুটি বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তন ঘটল। এক. সম্পদের উপর ব্যক্তিমালিকানা স্থাপিত হলো; দুই. বংশানুক্রমিক সামন্ততন্ত্র কায়েম হলো। সমাজপতি ভূ-পতি হলেন, কৃষককূল প্রজা হলো। নিয়ম হলো প্রজারা তাদের উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ খাজনা হিসেবে সামন্ত প্রভু তথা-জোতদার, জমিদার বা রাজাকে দিতে বাধ্য থাকবেন। সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার কোনো অগ্রগতি না হলেও একদিকে কৃষিপণ্যের বৈচিত্র্য বেড়েছিল, অন্যদিকে কৃষিপণ্য বিপণন প্রসারিত হয়েছিল। কৃষি কৌশলের উন্নয়নের প্রয়োজনে এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন মানবিক চাহিদা মেটাতে কৃষিভিত্তিক শিল্প যেমন- বস্ত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিযন্ত্র ইত্যাদির একে একে বিকাশ ঘটল। উৎপাদনের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ বাড়তে লাগল।
Read more